২০০৯ এর প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গ গণ সংস্কৃতি পরিষদ, অঙ্গন মঞ্চের নাটকের একটি কর্মশালার আয়োজন করে। কাণ্ডীরের সলতে পাকানোর শুরু সেই কর্মশালাতেই। যাদবপুর, সন্তোষপুর এবং আসপাশের এলাকার কয়েকজন মানুষ মিলে তৈরী হ’ল ‘কাণ্ডীর’। মূলত সমাজ-রাজনীতিকে বিষয় করে সংস্কৃতি চর্চার প্রয়াসের সিদ্ধান্ত নেয়। আঙ্গিক রূপে মূলতঃ অঙ্গন মঞ্চ ও পথ নাটক (অ্যাজিট প্রপ গোছের) এই দুই মাধ্যমকেই প্রথমিক ভাবে চর্চার ভর কেন্দ্রে রাখা হয়। পশ্চিমবঙ্গ গণ সংস্কৃতি পরিষদ এর অন্তর্ভুক্ত একটি সংগঠন রূপেই কাণ্ডীরের যাত্রা শুরু।
শুরুতো হলো বটে, কিন্তু শুরুটা হবে কি দিয়ে! সাম্প্রতিক সমাজ রজনীতি বিষয়ক অঙ্গন মঞ্চে অভিনয় যোগ্য একটি নাটক চাই, কুশীলবদের আভিনয় গুছিয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত নাটকটা নামাতে পারবেন এরকম একজন লোক চাই। এই সব বিষয়ে কাণ্ডীরের ভাঁড়ার প্রায় শুন্য। সাধারনতঃ একজন নাট্য ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্রে রেখে বা এক দল নিয়মিত নাট্যকর্মী সম্মিলনে নতুন নাট্যদল গড়ে ওঠে। কাণ্ডীরের গোড়ার সমষ্টিতে ছিল তিন ধরণের মানুষের সমাবেশ। একাংশ ছিল যাঁরা কোনোদিন আভিনয় (সুযোগের অভাবে বা ভয়ে), দ্বীতিয়াংশে অনিয়মিত ভাবে মঞ্চে অভিনয় করা মানুষ আর একদা দশ চক্রে পরে নাটকের নানা কর্মশালা ইত্যাদিতে অংশ নিয়ে অঙ্গন মঞ্চের কয়েকটি নাটকে অভিনয় করে অন্যান্য কাজে ভিড়ে গেছে যাদের সাংস্কৃতিক কাজ মূলতঃ সংগঠকের। কি করি, কি করা যায় এই সব ভাবতে ভাবতেই এই বছরের বিশে জুলাই আধুনা প্রায় কলকাতা মেট্রোর গ্রাসে প্রায় লুপ্ত “কার্জন পার্কে” কাণ্ডীর রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারার চিন্তাসূত্রে একটি বাচিক আলেখ্যের উপস্থাপনা করে ফেলল। বস্তুতঃ এই উপস্থাপনার মাধ্যমেই কাণ্ডীরের প্রথম জনসমক্ষে আসা। সমসময়ে অঙ্গন মঞ্চের নাটকের কয়েকটি দলের পারস্পরিক বোঝাপড়ার সমন্বয়ে কিছু গোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকলেও জন্মলগ্ন থেকে কাণ্ডীর এই ধরণের গোষ্ঠীগুলির বাইরে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেছে। সুতরাং শুরু হল’ “একলা জগাই এর লড়াই।“ নাটকের খানিকটা কাঠামো লেখার পরে মহড়ায় বসা হল’, বাকীরা আর একটু এগিয়ে দিল নাটকটাকে। এই করতে করতে একদিন মোটামুটি নাটকটা নড়বড়ে হলেও দাঁড়াল। বাকীটা মহড়া চলতে চলতে ঠিক হল’। এইভাবেই তেরী হল’ কাণ্ডীরের প্রথম অঙ্গন মঞ্চের নাটক “ট্যালেন্ট হান্ট”। গণ মাধ্যমে প্রায়োগিক সংস্কৃতির বিপুল পূঁজির ব্যবহার আর এই প্রতিযোগিতার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে, সস্তার রজনীতি প্রচারের প্রচেষ্টাকে ব্যঙ্গ করে এই নাটকের প্রথম অভিনয় ২০১০ এর ডিসেম্বর মাসে কৃষ্ণনগরে পশ্চিমবঙ্গ গণ সংস্কৃতি পরিষদ আয়োজিত সৃজন উৎসবে। নাটকের সব উপাদানের মিশেল ঠিক ঠাক না হলেও, অনভিজ্ঞতার ইতস্তত ছাপ থাকলেও স্বল্প পরিসরে নাটকটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১৩ পর্যন্ত কাণ্ডীর মোট তিনটি নাটক প্রযোজনা করে। এর মধ্যে “রাখাল বড় সুবোধ বালক”পথ নাটকটি গ্রাম বাংলায় প্রচন্ড সাড়া পায় এবং অনেকবার প্রদর্শন করে। পশ্চিমবঙ্গ গণ সংস্কৃতি পরিষদ আয়োজিত সাংস্কৃতিক পরিক্রমায় সকাল ১০ টা থেকে রাত ১০ টার মধ্যে কোন কোন দিন নাটকের চার বার প্রদর্শন ও করতে হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ এই সময়টা ছিল কাণ্ডীরের গড়ে ওঠার পর্যায়। এই পর্যায়ে অন্য সব দলের মতই সদস্যদের যাওয়া আসার কাল। হেনরী স্লেশার এর একটি ছোট গল্পের সূত্র অবলম্বনে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার রাজনেতিক সমালোচনা করে তেরী নাটক “গাধা মঙ্গল কাব্য” কে কেন্দ্র করে কাণ্ডীর একটি সংহত রূপ পায়। এর আব্যবহিত পরেই এই সংগঠনের গুণগত পরিবর্তন ঘটে। এই সময় কাণ্ডীর কয়েকটি পরিবারের সমন্বয়ের একটি দল হয়ে ওঠে। এই সময় থেকেই বাবা, মা ও তাঁদের সন্তান/সন্ততি সবাই কাণ্ডীরের অংশ। ফলে এক ঝাঁক ছোটদের সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণের জন্যে তৈরী হয় “ছোটদের কাণ্ডীর”। প্রথম প্রযোজনা উপেন্দ্রকিশোর রায় এর “সাক্ষী শেয়াল”। একই সময়ে প্রথমে ছোটোদের মূকাভিনয় ও গানের চর্চা শুরু হয়। পরিবেশ চেতনা কেন্দ্রীক “ছোটোদের কাণ্ডীরে”র মূকাভিনয় “বাঁচার আনন্দে” বহুবার প্রদর্শিত হয়। “ছোটদের কাণ্ডীর”এর গানও প্রশংসিত হয়েছে। “ছোটদের কাণ্ডীর” এর বারো বছরের ঝুলিতে দুটো মূকাভিনয় আর চারটি নাটক সহ গান ও বাচিকের অনুষ্ঠানে পূর্ণ। সেদিনের ছোটোরা আজ যুবক/যুবতী। কালস্রোতে “ছোটদের কাণ্ডীর” মিশে গেছে কাণ্ডীরের মূল স্রোতে। প্রায় একই সময়ে কাণ্ডীরও প্রথমতঃ নাটকের প্রয়োজনে মূকাভিনয়ের ও গানের চর্চা শুরু করলেও অনতিবিলম্বে এই দুই মাধ্যম কান্ডীর এর নিয়মিত চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। কাণ্ডীরের গণ সঙ্গীতের দলটি একটি মান অর্জন করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়। ২০২৩ এ ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত বামফ্রন্টের এক জনসভায় গণ সঙ্গীত পরিবেশনের আমন্ত্রণ পায়। এই অনুষ্ঠানে কাণ্ডীরের গান উচ্চ প্রশংসা অর্জন করে। পেশাগত ও আন্যান্য কারণে সময়ের অভাবে গানের দলটি বর্তমানে অনিয়মিত হয়ে পরেছে। ২০১৩ তে কাণ্ডীরে যোগ দেওয়া এক সদস্য অনেক দিন ধরেই মূকাভিনয়ের চর্চায় নিযুক্ত ছিলেন এবং এই বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। নানা কারণে একক অভিনয় না করলেও সম্মেলক অভিনয়ে তিনি পরিচিত। মূলতঃ তাঁরই নেতৃত্বে আর বাকী সদস্যদের আগ্রহে কান্ডীরে নিয়মিত মূকাভিনয় চর্চা শুরু হয়। সম্মেলক অভিনয় উপস্থাপনায় “ছোটদের কাণ্ডীর” আগ্রগামী হলেও ঠিক তার পরেপরেই কাণ্ডীরও কুসংস্কারের বিরোধী একটি সম্মেলক আভিনয় দিয়ে উপস্থাপনা দিয়ে কাণ্ডীরের মূকাভিনয় উপস্থাপ্নার পর্ব শুরু। এর পরে ধর্মীয় মেরুকরণের বিরোধে “কালো নদী কে হবি পার” প্রদর্শনের মাধ্যমে। এর পরে অতিমারী কালে আকস্মিক লক ডাউনের আভিঘাতে তৈরী হয় “পরিযায়ী”। এই ভাবে হাঁটতে হাঁটতে ২০২৫ এর এপ্রিলে ৪টি সম্মেলক ও দুটি একক অভিনয়ের সম্মিলনে “নৈশব্দের কলতান” শিরোনামে মূকাভিনয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠান কলকাতার যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমির মঞ্চে উপস্থাপিত হয়। ২০২০ থেকে ২০২২। আতিমারির কাল। আকস্মিক লক ডাউন ঘোষণায় বিপর্যস্ত জনজীবন। কাণ্ডীর দলগত ভাবে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে সদস্যদের উপরি সময় চর্চার কাজে লাগায়। গান ও মূকাভিনয় এই দুই মাধ্যম এই সময়েই একটি মানে পৌঁছায়। এই পর্যায়ে উপস্থাপনার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়। নিয়মিত এই মিডিয়ায় ছোটো নাটক, বাচিক, গান এমন কি মূকাভিনয় ও উপস্থাপিত হয়। কাণ্ডীরের ইউ টিউব চ্যানেলে সেই সময়ের কিছু উপস্থাপনা তার সাক্ষী হয়ে আছে। অতিমারি কাল শেষ হবার পরে কাণ্ডীর মঞ্চ নাটকের উদ্যোগ নেয়। কাণ্ডীরের কয়েক জন সদস্য অন্য দলে মঞ্চ নাটকের কাজে আগে থেকেই যুক্ত ছিল মূলতঃ তাঁরাই এই কাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। দীর্ঘ মহড়ার পরে ২০২৪ এর ২৯ মার্চ যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমির মঞ্চে প্রদর্শিত হয় কাণ্ডীরের প্রথম মঞ্চ নাটক “সংযাত”। ২০০৯ থেকে ২০২৬ এই সাতারো বছর নানা ঘাত প্রতিঘাত, ওঠা পড়ার মধ্য দিয়ে কাণ্ডীর সংহত হয়েছে। অন্ততঃ ৬ জন কৈশোরের পাট প্রায় চুকিয়ে ফেলয় কাণ্ডীরের কুশী লবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামীতে কাণ্ডীর নাটক (অঙ্গন মঞ্চ, পথ নাটক ও মঞ্চ নাটক), মূকাভিনয় নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি রাখছে। সমাজ মাধ্যমে, মূলতঃ ইউ টিউব চ্যানেলে ও ওয়েব সাইটে সাম্প্রতিকতম সামজিক বিষয়গুলি কেন্দ্র করে নিয়মিত উপস্থাপন করা। কাণ্ডীরের বন্ধু শুভানুধ্যায়ীদের কাছে আমাদের আমাদের এই নতুন মাধ্যমে নতুন উদ্যোগকে সর্বতো ভাবে সাহায্য করবেন।